মুঘল সাম্রাজ্য প্রশ্ন উত্তর

মুঘল সাম্রাজ্য প্রশ্ন উত্তর

মুঘল সাম্রাজ্য প্রশ্ন উত্তর:

1. বাবর কে ছিলেন?

উত্তর: জাহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। বাবরের বাবা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন মধ্য এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র ফারগানা রাজ্যের সাধারণ রাজা। পিতার দিক থেকে তিনি ছিলেন তৈমুরের বংশধর এবং তাঁর মা কুতলুগ নিগার খানুম ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর বংশধর। কাজেই তুর্কি মোঙ্গল, তৈমুর লঙ চেঙ্গিস খাঁ এই দুই ব্যক্তির রক্তই তার দেহে মিলিত হয়েছিল।
 

বাবার মৃত্যুর পর 1494 সালে মাত্র 11 বছর বয়সে বাবর ফারগানা রাজ্যের  রাজার প্রতিষ্ঠিত হন। বাবর 1504 খ্রিস্টাব্দে কাবুল অধিকার করে আফগানিস্তানের বাদশাহ উপাধি নেন। কাবুল গজনী কান্দাহার জয় করার পর 1526 খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লিতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
 

2. পানিপথের প্রথম যুদ্ধ কেন হয়েছিল?

উত্তর: পাঞ্জাবের আফগান শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লোদী দিল্লির সিংহাসন দখলের বাসনায় এবং সুলতানের আত্মীয় আলম খাঁ লোদী ষড়যন্ত্র করে বাবরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণে কালবিলম্ব না করে বাবর 12000  সৈন্য নিয়ে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। ধন-সম্পদের প্রলোভন বাবরকে ভারত আক্রমণের উৎসাহিত করেছিল।
 
দৌলত খাঁ আশা করেছিলেন বাবর তার পূর্বপুরুষ তোর মনের মত ভারতের সম্পদ লুন্ঠন করে নিজের দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু বাবর যখন লাহোর অধিকার করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য উদ্যত হলেন, তখন দৌলত খাঁ বাবরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন এবং বাবর দিল্লির দিকে অগ্রসর হন।
 

3. পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর কেন জয়লাভ করেছিল?

উত্তর: 1526 খ্রিস্টাব্দে 21 শে এপ্রিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর 12 হাজার সৈন্য নিয়ে ইব্রাহিম লোদীর 1 লক্ষ সেনা 1 হাজার হস্তী বাহিনীকে পরাজিত করে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। এই যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের প্রধান কারণগুলি ছিল
 
1. বাবরের কামান, বন্দুক ধারি সুশিক্ষিত সুদক্ষ সেনাবাহিনীর সামনে সুলতানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। কামানের ব্যবহার বাবরকে জয়ী করেছিল।
 
2. ইব্রাহিম লোদীর অত্যাচার অপদার্থতার ফলে তাঁর প্রতি অভিজাত সম্প্রদায়ের আনুগত্য জনসমর্থন ছিল না। অভিজাতদের ষড়যন্ত্র সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ।
 
3.  বাবর উন্নত রণকৌশল যোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত নিহত করেছিল।
 
4. মেবারের রানা সঙ্গ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরকে সাহায্য করেন।
 

4. পানিপথের প্রথম যুদ্ধের গুরুত্ব কী?

উত্তর: 1526 খ্রিস্টাব্দে 21 এপ্রিল বাবর ইব্রাহিম লোদীর মধ্যে যে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল, ভারতের ইতিহাসে  তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
 
1. প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবর জয়লাভের ফলে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের লোদী বংশের শাসন ক্ষমতার চিরতরে লুপ্ত পায় অর্থাৎ ভারতে তুর্ক-আফগান সুলতানি সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
 
2. এই যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাবর দিল্লি আগ্রা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
 

5. খানুয়ার ঘর্ঘরার যুদ্ধ কী হয়েছিল?

উত্তর: খানুয়ার যুদ্ধ: নবগঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য বাবর মেবারের রানা সঙ্গের বিরুদ্ধে 1527 খ্রিস্টাব্দে যে যুদ্ধ করেন, তা খানুয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। ভারতবর্ষের বহু যুদ্ধের নায়ক রানা সঙ্গ অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেও এই যুদ্ধে পরাজিত হন।
 
ঘর্ঘরার যুদ্ধ:  ইব্রাহিম লোদীর ভাই মামুদ লোদীর অধীনে আফগানরা আবার সঙ্গবদ্ধ হয়ে বাবরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিল এবং বাংলার নবাব নসরৎ শাহ তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। পাটনার অনতিদূরে ঘর্ঘরা নদীর তীরে বাবর আফগান নেতাদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। ফলে বাবর মুঘল সাম্রাজ্য পশ্চিমে অক্ষু নদী থেকে পূর্বে ঘর্ঘরা নদী পর্যন্ত এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিনে গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তার করেন।
 

6. বিলগ্রামের যুদ্ধ কী হয়েছিল?

উত্তর: 1539 সালের 27 শে জুন চৌসার প্রান্তরে শের খাঁর কাছে পরাজিত হয় এবং অতি কষ্টে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হন। হুমায়ুন কিন্তু চৌসার যুদ্ধের ফলাফলে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই পরের বছর তিনি আবার শেরশাহের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন।
 
1540 খ্রিস্টাব্দের 17 মে শেরশাহ মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের মধ্যে কনৌজ বা বিলগ্রামের যুদ্ধে হুমায়ুনের বাহিনী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয় এবং হুমায়ুন ভারত ছেড়ে পারস্যে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আফগান বীর শেরশাহ হুমায়ুনের পিছু নিয়ে দিল্লি দখল করে দিল্লিতে শূর বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ভারতে সাময়ীকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান হয়েছিল।
 

7. শেরশাহ কে ছিলেন?

উত্তর: শূর বংশীয় আফগান শেরশাহের প্রকৃত নাম ছিল ফরিদ তাঁর বাবা হাসান ছিলেন বিহারের অন্তর্গত সাসারামের জায়গীরদার। 1522 খ্রিস্টাব্দে বিহারের সুলতান বাহার খাঁ লোহানীর অধীনে তিনি চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর সাহস বীরত্বের জন্য লোহানী তাকে 'শের খাঁ' উপাধি দেন।
 
বাহার খাঁ লোহানীর মৃত্যুর পরে বিহারের নাবালক শাসক জালাল খাঁ লোহানী বাংলা সুলতান মামুদ শাহের সম্মিলিত বাহিনীকে 1534 খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে পরাজিত করে শের খাঁ নিজেকে বিহারের সুলতানিরূপে প্রতিষ্ঠা করেন এবং 1537 খ্রিস্টাব্দে মামুদ শাহকে পরাজিত করে বাংলার আধিপত্য লাভ করেন।
 
1540 খ্রিস্টাব্দের 17 মে কনৌজ বা বিলগ্রামের যুদ্ধে শেরশাহ মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে দিল্লি দখল করেন এবং দিল্লিতে শূর বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্বে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমে সিন্ধুদেশ পর্যন্ত তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
 
শেরশাহ তার শেষ অভিযান কালিঞ্জর দুর্গের বিরুদ্ধে বিজয়ের মুহূর্তে বারুদের স্তূপে আগুন লেগে আকর্ষণী গ্যাস বিস্ফোরণে 1545 খ্রিস্টাব্দে 22 শে মে নিহত হন।
 

8. কবুলিয়াত পাট্টা কী?

উত্তর: শেরশাহ রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য কবুলিয়ত পাট্টা প্রথার প্রবর্তন করেন। রাজস্ব নির্ধারণের জন্য তিনি সাম্রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করার প্রথা চালু করেন এবং উৎপাদন শক্তি অনুযায়ী জমিগুলোকে ভাল, মাঝারি মন্দ এই তিন শ্রেনীতে ভাগ করেন।
 
কৃষি জমিতে সম্রাটের কী খাজনা প্রাপ্য তা স্বীকার করে কৃষককে দিতে হত লিখিত কবুলিয়াত
 
জমিতে প্রজার স্বত্ব দেয় খাজনা উল্লেখ করে প্রতিটি প্রজাকে পাট্টা নামে এক দলিল দেওয়া হত।
 
মূলত এই দুই পত্রে সরকার কৃষকদের দেনা-পাওনার কথা পরিষ্কার লেখা থাকতো। কবুলিয়ত পাট্টা প্রথার মাধ্যমে সম্রাট কৃষকের পরস্পরের অধিকার কর্তব্য সুরক্ষিত হয়েছিল।
 

9. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ কেন হয়েছিল?

উত্তর: হুমায়ুনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সুলতান মহম্মদ আদিল এর হিন্দু মন্ত্রী হিমু দিল্লি অগ্রা জয় করে বিক্রমজিৎ উপাধি ধারণ করে নিজেকে দিল্লির স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। আকবর সিরহিন্দে চলে যান।
 
তবে হিমুর বেশি শক্তি সঞ্চয় করার আগেই হুমায়ুনের বিশিষ্ট বন্ধু নাবালক আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ সসৈন্যে পাঞ্জাব থেকে দিল্লি দিকে অগ্রসর হন।
 
1556 খ্রিস্টাব্দে 5 নভেম্বর আবার সেই পানিপথের প্রান্তরেই মুঘল আফগানদের মধ্যে দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ হয় এবং হিমু পরাজিত হন।
 

10. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব কী ছিল?

উত্তর: পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ প্রথম যুদ্ধ অপেক্ষা কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারতের ইতিহাসে এই যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। এই যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল প্রধানত দুটি, যেমন
 
1. এই যুদ্ধের ফলে ভারতে আফগান শাসনের আকাঙ্ক্ষা চিরদিনের মতো বিলীন হয়ে যায়।
 
2. এই যুদ্ধের দ্বারাই আকবর ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যকে পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিত্তি স্থাপিত হয়। যার অস্তিত্ব টিকে ছিল পরবর্তী 300 বছর। এই কারণেই আকবরকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
 

11. আকবরের রাজপুত নীতি কী ছিল?

উত্তর: ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য সূচনা পর্বে রাজপুত্ররা ছিল মুঘলদের এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। দূরদর্শী আকবর এর শক্তিশালী রণনিপুন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অহেতুক কোন সংঘর্ষে না গিয়ে তাদের নানান সুবিধা প্রদান করে এবং তাদের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করেন। আকবরের এই নীতি  রাজপুত নীতি নামে পরিচিত।
 
আকবরের রাজপুত  নীতির প্রধান দুটি দিক হল
 
1. মিত্রতার নীতি: বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, উচ্চ পদে নিয়োগ এবং বিশেষ সুবিধা প্রদান প্রভৃতি হল আকবরের রাজপুতদের প্রতি মিত্রতার নীতি। আকবর এই মিত্রতা নীতি প্রয়োগ করে বিনা যুদ্ধে একে একে কালিঞ্জর, অম্বর, বিকানীর, জয়সলমীর প্রভৃতি রাজপুত রাজ্যগুলি সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
 
2. সংঘর্ষ নীতি: মিত্রতা নীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজপুতানা জয়ের জন্য আকবরকে কোন কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধনীতিও গ্রহণ করতে হয়। যেমন- মাড়োয়ারের রাজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং মেবারের রাজা রানা উদয় সিংহ এবং তাঁর পুত্র রানা প্রতাপ সিংহ আকবরের বশ্যতা স্বীকারে রাজি না হলে, আকবর চিতোর আক্রমণ করে দখল করেন।
 

12. রানা প্রতাপ কেন স্মরণীয়?

উত্তর: গন্ডোয়ানা রাজ্য জয়ের পর আকবর রাজপুতানার দিকে দৃষ্টি দেন। একে একে কালিঞ্জর, অম্বর, বিকানীর, জয়সলমীর, মাড়োয়ার প্রভৃতি রাজপুত রাজ্য তিনি সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু মেবার রাজ্যটিকে জয় করতে আকবরকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।
 
মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের পুত্র উদয় সিং কোনভাবেই আকবরের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি না হওয়ায় 1567 খ্রিস্টাব্দে আকবর মেবারের রাজধানী চিতোর আক্রমণ অবরোধ করেন। যুদ্ধে পরাজিত হয় উদয় সিং চিতোর ্যাগ করতে বাধ্য হন।
 
1572 খ্রিস্টাব্দে রানা উদয় সিংহের মৃত্যুর পর তার বীরপুত্র রানা প্রতাপ সিংহ জীবনের সব সুখ স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম চালিয়ে যান, কিন্তু 1576 খ্রিস্টাব্দে আরাবল্লী পর্বতের কাছে হলদিঘাটের যুদ্ধে অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেও মুঘল সেনাপতি মানসিংহ আসফ খাঁর কাছে তিনি পরাজিত হন।
 
তবে প্রতাপ সিংহ আমৃত‍্যু মুঘলের বশ‍্যতা স্বীকার করেননি এবং মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে তিনি রাজধানীর চিতোর ব্যতীত মেবারের অধিকাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।
 
সুদীর্ঘ সংগ্রামময় জীবনে আত্মবিশ্বাস, সাহস চরম বীরত্বের জন‍্যই রানা প্রতাপ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

Theme images by chuwy. Powered by Blogger.