সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণগুলি | Causes of Santhal Rebellion
1855 খ্রিষ্টাব্দে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল কেন
ভারতে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে যে সমস্ত উপজাতি বিদ্রোহ ঘটেছিল তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তাক্ত বিদ্রোহ ছিল উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের সাঁওতাল বিদ্রোহ।সাঁওতাল বিদ্রোহ নানা কারণে সংঘটিত হয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল –
রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অর্থাৎ দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের পাথুরে ও জঙ্গলাকীর্ণ জমিকে সাঁওতালরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে চাষযোগ্য উর্বর কৃষি জমি তৈরি করেন। জমিদার, ইজারাদার ও মহাজনরা নানা অজুহাতে তাদের এই জমিগুলি দখল করতে থাকে। ফলে সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুরু হলে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিযুক্ত জমিদাররা জমির ওপর খাজনা ধার্য করে এবং অল্প সময়ের মধ্যে সেই খাজনা প্রায় 10 গুণ বৃদ্ধি পায়। অত্যধিক হারে খাজনা মেটাতে নাজেহাল সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
নতুন ভূমি রাজস্ব নীতি প্রচলিত হওয়ার ফলে সাঁওতালরা তাদের চিরাচরিত অরণ্যের অধিকার হারিয়েছিল। অরণ্যের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ সাঁওতালদের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি করে, যা এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
কোম্পানির নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় নগদ অর্থে খাজনা দিতে হতো। সাঁওতালরা এই নগদ অর্থ সংগ্রহের জন্য মহাজনদের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হত এবং মহাজনরা এই ঋণের ওপর চড়া সুদ আদায় করত। গরিব সাঁওতাল চাষের পক্ষে এই ঋণের অর্থ শোধ করা কোনদিনও সম্ভব হতো না। ফলের ঋণের দায়ে গরিব চাষির সম্পত্তি মহাজন দখলে চলে যেত। একে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয়।
ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের নানাভাবে শোষন করতো। বেশি দামে জিনিসপত্র বিক্রি করা, জোর করে স্বল্পমূল্যে জমির ফসল কিনে নিত। বাটখারাতেও কারচুপি অর্থাৎ সাঁওতালদের কাছ থেকে কিছু কেনার সময়ই কেনারাম নামক বেশি ওজনের বাটখারা এবং তেল, লবণ প্রভৃতি বিক্রির সময় বেচারাম নামক কম ওজনের বাটখারা দিয়ে ওজন করে সাঁওতালদের পণ্য কম দিয়ে ঠকাত।
লর্ড ডালহৌসির আমলে ভাগলপুর, রাজমহল, রামপুরহাট প্রভৃতি অঞ্চলে রেল লাইনের কাজ শুরু হয়। এর জন্য এই অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মচারী ও ঠিকাদাররা আসে। তারা নানাভাবে সাঁওতালদের উপর অত্যাচার করত। সাঁওতালদের নামমাত্র মজুরিতে কাজ করানো, তাদের হাঁস-মুরগির ছাগল কেড়ে নেওয়া, এমনকি নারীদের সম্মানহানি প্রভৃতি। এতে সাঁওতালরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
খ্রিস্টান মিশনারীরা বিভিন্ন এলাকায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করে এবং অনেক সময় তারা জোর জুলুম করে সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। ফলে সাঁওতালরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
সাঁওতালরা তাদের নিজস্ব নিয়মে চলত। ইংরেজরা সাঁওতাল সমাজে ব্রিটিশ আইন কার্যকর করলে সাঁওতালদের চিরাচরিত উপজাতীয় সংগঠন ভেঙ্গে পড়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়।
সাঁওতাল সম্প্রদায় বিশ্বাস করত প্রাচীনকালে তারা চম্পা নামে এক রাজ্যে বাস করত এবং তখন তারা ছিল স্বাধীন ও মুক্ত। সাঁওতালরা ইংরেজ শাসনের অধিকার ছিন্ন করে আগের শোষণমুক্ত ও স্বাধীন সমাজে ফিরে যাওয়ার জন্য বিপ্লব শুরু করে।